স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার অভ্যুদয়ের ইতিহাস। পর্ব: 3 ইলিয়াসশাহীর শাসনামলে বাংলা
![]() |
| Bengal under the regime of Elias shahi |
ইলিয়াসশাহীর শাসনামলে বাংলা
Bengal under the regime of Elias shahi ইলিয়াস শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বংশ ১৪১২ থেকে ১৪৩৫/৩৬ পর্যন্ত তেইশ বছরের বিরতিসহ প্রায় দেড় শ' (১৩৪২-১৪৮৭) বাংলা শাসন করে। ইলিয়াসশাহী আমল নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সালতানাত সুসংহত হয় এবং এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এ আমলে মুসলিম শাসনব্যবস্থা একটি রূপ লাভ করে। শিল্প, সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য সমুদ্ধ হয়। মুসলিম শাসকগণ স্থানীয় জনগণের ওপর স্থাপন করে দেশের শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশ গ্রহণের স্বার উন্মুক্ত করে দেন। এভাবে বিদেশি মুসলিম শাসন বাঙালি মুসলিম শাসনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া এ আমলেই শুরু হয়। সর্বোপরি সমগ্র রাজ্য যা এতদিন একক কোন পরিচিত না হয়ে বঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি বিডিন্ন আঞ্চলিক নামে পরিচিত ছিল তা বাঙ্গালাহ নামে অভিহিত হয়। ইলিয়াসশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলার স্বাধীন সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হাজী ইলিয়াস ছিলেন সিজিস্তানের একজন অভিজাত। প্রথমে তিনি দিল্লির মালিক ফিরুজের অধীনে চাকরিতে নিয়ােজিত ছিলেন। পরে তিনি সাতগাঁও শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি মালিক পদে উন্নীত হন এবং ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি সাতগায়ের অধিকর্তা হন। সাতগাঁয়ে নিজের শক্তি সংহত করে হাজী ইপিয়াস হিজরিতে (১৩৩৯ খ্রি.) লখনৌতির আলী মুবারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং তার স্গে দীর্ঘ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন। সংঘর্ষে হাজী ইলিয়াস জয়লাত করেন। তিনি সুলতান শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইলিয়াস শাহ উপাধি গ্রহণ করে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং বাংলায় ইলিয়াসশাহী সালতানাতের ভিত্তি স্থাপন করেন। সালতানাত প্রায় দেড় শ' বছর স্থায়ী হয়েছিল (১৩৪২-১৪৮৭)। ইলিয়াস শাহ একজন দৃঢ়চেতা ও দক্ষ শাসক ছিলেন। বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির বলে তিনি শাহ-ই-বাঙ্গালাহ, শাহ-ই-বাঙালিয়ান ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি করেন। তিনি প্রায় যােল বছর রাজত্ব করার পর ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাণুয়ায় মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর পরে তার সিকান্দর শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিকান্দর শাহ প্রায় তেত্রিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল গৌরবােজ্জবল। তিনি পাণডয়ার নিকটবর্তী গােয়ালপাড়ায় তাঁর পুত্র আজম শাহের সঙ্গে যুদ্ধে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজম সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ' উপাধি ধারণ করে ৭৯৩, হিজরিতে (১৩৯০-৯১ খ্রি.) সিংহাসনে আরােহণ করেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ৮১৩ হিজরিতে (১৪১০-১১ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র সাইফুদ্দীন হামজা শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি মাত্র এক বছর কয়েক মাস (৮১৩ হি./১৪১০-১১ খ্রি-৮১৪ হি/১৪১১-১২ খ্রি.) বাংলা শাসন করেন। তাঁর রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার ভাতুরিয়ার জমিদার রাজা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং তারই প্ররােচনায় সুলতানের ক্রীতদাস শিহাবুদ্দীন তার প্রভুকে হত্যা করে নিজেই বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন। যখন এ ঘটনা ঘটছিল, তখন সম্ভবত মুহম্মদ শাহ বিন হামজা শাহ বাংলার কোনাে নিজেকে সুলতান বলে ঘােষণা করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। সম্ভবত তিনি তাঁর অবস্থান রক্ষা করতে নি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি রাজা গণেশ ও শিহাবুন্দীনের কাছে পরাজিত হন। এভাবে ইলিয়াস শাহী শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সুলতান সাইফুদ্দীন হামজা শাহের ক্রীতদাস শিহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহ ৮১৪ হিজরি (১৪১১-১২ খ্রি.) থেকে (১৪১৪ খ্রি.) পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। শিহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহ ও রাজা গণেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক বেশি ছিল না। শিহাবুদ্দীন রাজা গণেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন এবং কিছু সময়ের জন্য তাকে আটক ক্ষমতা খর্ব করেন। তিনি সুলতান শিহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহ উপাধি ধারণ করে নিজ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। রাজা গণেশ সুলতানের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেন (৮১৭হি./১৪১৪ শিহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহের পুত্র আলাউদ্দীন ফিরুজ শাহ কোনরকমে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। কিন্ত রাজা গণেশ তাকে আক্রমণ করে নিহত করেন এবং নিজেই ৮১৭ হিজরিতে খ্রি.) বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন।

Post a Comment